বিশেষ প্রতিবেদক : বদরুদ্দীন উমর ১৯৩১ সালের ২০ ডিসেম্বর ভারতের বর্ধমানে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা আবুল হাশিম ভারতীয় উপমহাদেশের একজন মুসলিম জাতীয়তাবাদী রাজনীতিবিদ ছিলেন। ষাটের দশকে বাংলাদেশে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন আর ধর্ম ও রাজনীতি নিয়ে তাঁর লেখা বইগুলো বাংলাদেশের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে সাংস্কৃতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। তাঁর চিন্তা বুঝতে সহায়ক বিশেষ করে ‘সাম্প্রদায়িকতা’ (১৯৬৬), ‘সংস্কৃতির সংকট’ (১৯৬৭), ‘সাংস্কৃতিক সাম্প্রদায়িকতা’ (১৯৬৯)-তিনটি বই। এই বই লিখেই তিনি ক্ষান্ত হননি। শাসকদের অধীনে চাকরি পর্যন্ত করবেন না, এ মনোভাব পোষণ করে চাকরি থেকে ইস্তফা দেন বদরুদ্দীন উমর। বরেণ্য এই বুদ্ধিজীবী, লেখক, গবেষক, ইতিহাসবিদ, চিন্তক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক গতকাল ( ৭ সেপ্টেম্বর ) মারা গেছেন। মৃত্যুকালে তার বয়স ছিল ৯৪ বছর। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে তার পেশাজীবন শুরু করেন। পরবর্তীকালে তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজবিজ্ঞান বিভাগ প্রতিষ্ঠা করেন। বাংলাদেশ কৃষক ফেডারেশনের সভাপতি এবং গণতান্ত্রিক বিপ্লবী জোটের কেন্দ্রীয় সমন্বয়কারী হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। এক সময় তিনি পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ছিলেন। ২০০৩ সালে তিনি জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল নামে একটি সংগঠন গড়ে তোলেন এবং এর সভাপতির দায়িত্ব নেন।
মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে শেখ হাসিনাসহ তিন জনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে চলা মামলার তদন্ত কর্মকর্তার কাছে সাক্ষী হিসেবে দেওয়া জবানবন্দিতে সদ্য প্রয়াত বরেণ্য বুদ্ধিজীবী, লেখক, গবেষক ও জাতীয় মুক্তি কাউন্সিলের সভাপতি বদরুদ্দীন উমর বলেছেন শেখ হাসিনা বাংলাদেশে ক্ষমতায় ছিল নির্বাচন গুলো নিয়ন্ত্রণ করার মাধ্যমে। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অপব্যবহার করে তিনি নির্বাচনী ব্যবস্থাকে নিজের করায়ত্ত করেছেন এবং প্রকৃতপক্ষে জনগণের সঙ্গে তার সম্পর্ক একেবারেই ছিন্ন করে ফেলেছিলেন।
এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর গাজী এমএইচ তামীম সাংবাদিকদের বলেন, প্রয়াত বদরুদ্দীন উমর শেখ হাসিনার মামলায় একজন গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী ছিলেন। উনি ট্রাইব্যুনালে এসে সাক্ষ্য প্রদান করতে পারলেন না, তবে এই মামলার তদন্ত কর্মকর্তার কাছে উনি ওনার সাক্ষ্য দিয়েছিলেন। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের আইনের ১৯(২) ধারা অনুযায়ী কোন সাক্ষী যদি তদন্ত কর্মকর্তার কাছে সাক্ষ্য দিয়ে মারা যান, সেক্ষেত্রে প্রসিকিউসনের আবেদনে ট্রাইব্যুনাল তদন্ত কর্মকর্তার কাছে দেয়া সাক্ষ্যকে গ্রহণ করতে পারেন। তদন্ত কর্মকর্তার কাছে দেওয়া জবানবন্দিতে বদরুদ্দীন উমর বলেন, শেখ হাসিনা বাংলাদেশে ক্ষমতায় ছিল নির্বাচনগুলো নিয়ন্ত্রণ করার মাধ্যমে। ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত প্রতিটি নির্বাচনই তিনি ম্যানিপুলেট করেছেন। এগুলো সম্ভব হয়েছে, কারণ রাষ্ট্রের প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের ওপর, নির্বাচন কমিশন থেকে শুরু করে পুলিশ ও আমলাতন্ত্র-সব কিছুর ওপর তিনি নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছিল। প্রথম থেকেই শেখ হাসিনা ঠিক করেছিলেন যে, তিনি নির্বাচন নিয়ন্ত্রণ করবেন। সেটি করতে গেলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার রাখা সম্ভব নয়। অথচ ১৯৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে তিনি আন্দোলন করেছিলেন, সংশোধনী এনেছিলেন। কোনো নীতিবোধ বা নৈতিক লজ্জাবোধ তার ছিল না।

বদরুদ্দীন উমর আরো বলেন, ২০০৯ সালে ক্ষমতায় এসে তিনিই সেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করে দিলেন কারণ তিনি বুঝেছিলেন যে নিরপেক্ষ নির্বাচন হলে, পরবর্তীকালে তারা আর জিততে পারবে না। সুতরাং নির্বাচনে জিততে হলে তাকে সবকিছু নিজের নিয়ন্ত্রণে আনতেই হবে। তিনি প্রশাসনকে দুইভাবে নিয়ন্ত্রণ করেছেন— প্রথমত ঘুষ, টাকা-পয়সা ও সুযোগ-সুবিধা দিয়ে এবং দ্বিতীয়ত হুমকি ও ভয়ভীতি প্রদর্শন ও নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমেই তিনি ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের নির্বাচনগুলো করেছেন। ২০১৪ সালে ভোটকেন্দ্রে কাউকে ঢুকতেই দেয়নি। ২০১৮ সালে ‘রাতের ভোট’ হয়েছে। দিনে ভোট হলেও, আসলে ভোট হয়ে গেছে আগের রাতেই। ২০২৪ সালেও একই ঘটনা। এভাবে নির্বাচন করেও তিনি জয়লাভ করেছেন। যদিও এগুলোতে জনসমর্থনের কোনো ভিত্তি ছিল না। এইসব নির্বাচনে তার দল ৩০০ সিটের মধ্যে চার-পাঁচটি সিটও পেতো কি-না সন্দেহ। এরপরও তিনি জয়ী হয়েছেন শুধুমাত্র প্রশাসনের ওপর চূড়ান্ত নিয়ন্ত্রণের কারণে। এটা গোপন কিছু না, সবাই জানে। একটি সরকার যদি চায়, তারা এইভাবে নির্বাচন নিয়ন্ত্রণ করবে, তাহলে সেটা ঠেকানো কঠিন। শুধু নির্বাচনের কারচুপিই নয়, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের ওপর নিষ্ঠুর দমন চালিয়েছে শেখ হাসিনা।
তিনি জবানবন্দিতে আরো বলেন, কোনো রাজনৈতিক দল যাতে কার্যকরভাবে নড়াচড়া করতে না পারে, সে জন্যও নির্যাতন করা হয়েছে। প্রচুর মানুষকে গ্রেফতার করে বছরের পর বছর আটকে রাখা হয়েছে বিনা কারণে। ‘আয়না ঘর’ নামে টর্চার সেল তৈরি করা হয়েছে, যেটা শেখ মুজিবের আমলেও ছিল না। শেখ মুজিব বিরোধীদের সরাসরি হত্যা করতেন। শেখ হাসিনা শুধু হত্যা করতেন না, নির্যাতনও করতেন এবং এতে এক ধরনের বিকৃত আনন্দ পেতেন। সুতরাং, এভাবে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অপব্যবহার করে তিনি নির্বাচনী ব্যবস্থাকে নিজের করায়ত্ত এবং প্রকৃতপক্ষে জনগণের সঙ্গে তার সম্পর্ক একেবারেই ছিন্ন করেছেন।
তদন্ত কর্মকর্তার কাছে দেওয়া জবানবন্দিতে বদরুদ্দীন উমর বলেন, ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থান শুধু বাংলাদেশে নয়, গোটা ভারতীয় উপমহাদেশে একটি ব্যতিক্রমী ঘটনা। ভারত বা পাকিস্তানে এমন জনতার শক্তি ও ব্যাপকতার গণঅভ্যুত্থান কখনো দেখা যায়নি। বাংলাদেশ নিজেই একটি ‘গণঅভ্যুত্থানের দেশ।’ ১৯৫২, ১৯৬৯, ১৯৯০ সালের ঘটনাগুলো তার উদাহরণ। তবে এইসব অভ্যুত্থানের মধ্যে ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থান ছিল সবচেয়ে বিস্ফোরক, সবচেয়ে রূপান্তরমূলক। ভাষা আন্দোলনের (১৯৫২) মধ্য দিয়ে ভাষার স্বীকৃতি এসেছিল, ১৯৬৯-এ আইয়ুব খানের পতন হয়েছিল, ১৯৯০-এ এরশাদের পতনের মাধ্যমে একটি নির্বাচিত সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। কিন্তু এসব আন্দোলনে এমন সর্বগ্রাসী ভাঙন, এমন পলায়নপর সরকার বা দল দেখা যায়নি।
বদরুদ্দীন উমর আরো বলেন, ২০২৪ সালের অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা দেশ ছাড়তে বাধ্য হন। শুধু তিনিই নন-তার মন্ত্রিসভা, দলের কেন্দ্রীয় নেতারা, এমনকি তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীরাও দেশ ছেড়ে পালায়। এই রকম ব্যাপক দলীয় পতন, আতঙ্ক ও আত্মগোপন বাংলাদেশের ইতিহাসে আর কখনো ঘটেনি। সিরিয়া বা অন্য কোনো দেশে, স্বৈরাচার পতনের পরও এত সংগঠিত দলীয় পলায়ন দেখা যায়নি।
তিনি জবানবন্দিতে বলেন, এই অভ্যুত্থানের গভীরতা বোঝাতে একটি প্রতীকী চিত্র যথাযথ শেখ হাসিনার পালানোর পরদিন থেকেই সারা দেশে শেখ মুজিবের মূর্তি ও ম্যুরাল সাধারণ মানুষ নিজেরা ভেঙে ফেলে। কেউ কোনো নির্দেশ দেয়নি, তবুও এটি ঘটেছে। এটি এক ধরনের ‘প্রকৃতির প্রতিশোধ’, যার বহিঃপ্রকাশ জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিক্রিয়ায় হয়েছে। বহু বছর ধরে নির্যাতিত, অবদমিত জনগণের ক্রোধ এই অভ্যুত্থানে বিস্ফোরিত হয়েছে। শেখ মুজিব নিজেই এক সময় পার্লামেন্টে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, “সিরাজ শিকদার কোথায়?” যেটা ছিল একটি অমানবিক ব্যঙ্গ। কিন্তু ইতিহাসের প্রতিশোধ হয়েছিল ওই বছরেরই আগস্টে, যখন মানুষ বলেছিল, “শেখ মুজিব কোথায়?” এভাবে ইতিহাসে অনেক সময় ঘটনাগুলো পুনরাবৃত্তি হয় প্রতিশোধের রূপে।
সদ্য প্রয়াত বরেণ্য ইতিহাসবিদ তার জবানবন্দীতে আরো বলেন, এই অভ্যুত্থানের ফলে আওয়ামী লীগ শুধু ক্ষমতা থেকে বিতাড়িতই হয়নি, তারা জনগণের বিশ্বাস থেকেও বিতাড়িত হয়েছে। মুসলিম লীগের পতনের মতোই এবারের গণঅভ্যুত্থান আওয়ামী লীগের জন্য একটি চূড়ান্ত রাজনৈতিক পরিণতি তৈরি করেছে। ভারতের সহায়তায় তারা হয়তো কিছু অন্তর্ঘাতমূলক তৎপরতা চালাতে পারে, কিন্তু জাতীয় রাজনৈতিক দল হিসেবে তাদের পুনঃউত্থান অসম্ভব বলেই মনে হয়। এই অভ্যুত্থানের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো ছাত্রদের ভূমিকা। তারাই এই আন্দোলনের প্রধান চালিকা শক্তি ছিল। ইতিহাসে ছাত্ররা বারবার নেতৃত্ব দিয়েছে। কিন্তু এবারের আন্দোলনে তারা যে সাংগঠনিক শৃঙ্খলা, সাহস ও আত্মত্যাগের পরিচয় দিয়েছে, তা বিরল।

