নিজস্ব প্রতিনিধি : আওয়ামী লীগের সঙ্গে ‘আসন সমঝোতা হয়নি’ বলাবলি হলেও ২৬ আসনে ‘গোপন সমঝোতা’ করেছে জাতীয় পার্টি চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ কাদের, ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নুসহ শীর্ষ নেতারা। শুক্রবার রাতেই আওয়ামী লীগের সঙ্গে জাতীয় পার্টির নেতাদের বৈঠকে সমঝোতার বিষয়টি চূড়ান্ত করা হয়। আসন সমন্বয়ে দলের শীর্ষ পর্যায়ের নেতা কাজী ফিরোজ রশীদ, সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা, সালমা ইসলাম, লিয়াকত হোসেন খোকাসহ বেশ কিছু নেতাকে বাদ দেওয়া হয়েছে। তারা যে বাদ পড়ছেন, সেটা সমন্বয়ের দায়িত্বে থাকা নেতারা আগ থেকেই জানতেন। তা সত্বেও বিষয়টি গোপন রেখে শনিবার রাত পর্যন্ত, এমনকি রোববার (১৭ ডিসেম্বর) মনোনয়ন প্রত্যাহারের শেষ সময় পর্যন্ত ‘নাটক মঞ্চস্থ’ করেন জাপার এসব নেতা। বরং, এদিন বিকেলে শেষ সময়ে সংবাদ সম্মেলন করে ‘২৮৩ আসনে জাতীয় পার্টি নির্বাচন করছে’ জানালেও ২৬ আসনে আওয়ামী লীগের সঙ্গে জাতীয় পার্টির সমঝোতার বিষয়টি স্বীকার করে নেননি দলটির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু। অথচ, ওইদিন বিকেলে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে সুনির্দিষ্ট ২৬ আসনে আসন সমন্বয়ের তালিকা প্রকাশ করা হয়।
আসন সমন্বয়ের কথা প্রকাশ না করে রোববার বিকেলে মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, ‘আমরা নির্বাচন করছি ২৮৩ আসনে। সেখানে অন্য কোন দলের কোন প্রার্থী আছে, কী স্বতন্ত্র আছে, বিদ্রোহী প্রার্থী আছে- এগুলো আমরা চিন্তা করছি না। আমরা যুদ্ধ করে যাবো, খেলে যাবো। আর যেটা বলছেন, (আসন সমন্বয়) সেটা থাকতে পারে। কোনও আসনের বিষয়ে সেটা এখনও সুনির্দিষ্টভাবে আমাদের বলার সুযোগ নেই। এটা আমাদের নির্বাচনের কৌশল। সেই কৌশলের কারণে আমরা বলছি না’।
দলটির ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র জানায়, দু’দিন আগ থেকেই ২৬ আসনে নৌকা প্রার্থী আনুষ্ঠানিকভাবে প্রত্যাহার করার শর্তে ‘গোপন সমঝোতা’ করে জাতীয় পার্টি। কিন্তু, সেটি প্রকাশ না করার কৌশল নেন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান, এক জ্যেষ্ঠ কো-চেয়ারম্যান ও দলটির মহাসচিব; যাতে একদিকে নির্বাচন গ্রহণযোগ্য ও প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক করা, আর সেটা দেশ-বিদেশে দেখানো। অন্যদিকে, জাতীয় পার্টির ২৬ ছাড়া বাকি ২৫৭ আসনের দলীয় প্রার্থীদের বিদ্রোহ-হাঙ্গামা যেন প্রকাশ্যে না আসে সেই কৌশল নেওয়া হয়েছে। এ কারণে দফায় দফায় বৈঠক করে ‘সমঝোতা হয়নি’ বলে প্রচার করা হয়েছে।
সূত্র আরও জানায়, ২৮৩ আসনের মধ্যে মাত্র ২৬টিতে ‘গোপন সমঝোতা’ হওয়ায় বিপাকে পড়েছেন দলটির চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ কাদের, সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নুসহ সুবিধাভোগী শীর্ষ নেতারা। জিএম কাদের নিজের, স্ত্রী শেরিফা কাদের, কো-চেয়ারম্যান আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নুসহ বারবার সমঝোতায় নির্বাচিতদের স্বার্থ রক্ষা করতে পারলেও দলের ত্যাগী মধ্যমসারির নেতাদের জন্য কিছুই করতে পারেননি। জিএম কাদের ও চুন্নু কখনও কোনও দলের ‘দালালি’ করবেন না বলে তৃণমূল নেতাকর্মীদের কথা দিয়েছিলেন, কিন্তু এমপি হওয়ার ‘ব্যক্তি স্বার্থে’ তারা সে কথা রাখেননি। তাই দলের অধিকাংশ নেতাকর্মী কাদের, আনিস ও চুন্নুর ওপর এখন চরম ক্ষুব্ধ।
খবর নিয়ে জানা গেছে, আওয়ামী লীগের সঙ্গে ‘গোপন সমঝোতায়’ বাদ পড়া ২৫৭ আসনের প্রার্থী-সমর্থকরা জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের, কো-চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার আনিস ও মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নুর ওপর চড়াও হতে পারেন। এমনকি, তাদের কর্মী-সমর্থকরা হাঙ্গামা করতে পারেন বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। ক্ষুব্ধ হয়ে তাদের অনেকেই নির্বাচন বর্জনও করতে পারেন। মূলত, দলের মধ্যে বিদ্রোহ ও হাঙ্গামার ভয়ে আসন সমঝোতার বিষয়টি আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করছেন না জাপার শীর্ষ নেতারা।
জানা গেছে, আওয়ামী লীগের সঙ্গে জাতীয় পার্টির ‘গোপন সমঝোতায়’ দলের প্রভাবশালী তিন কো-চেয়ারম্যান কাজী ফিরোজ রশীদ, সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা ও যমুনা গ্রুপের চেয়ারম্যান সালমা ইসলাম, প্রভাবশালী প্রেসিডিয়াম সদস্য লিয়াকত হোসেন খোকা, নাসরিন হাওলাদার রত্না, পীর ফজলুর রহমানসহ অনেক শীর্ষ পর্যায়ের নেতা ও এমপি বাদ পড়েছেন। তারা নিজেরাই জানতেন, আসন সমঝোতায় তাদের নাম রয়েছে। তাদের অন্ধকারে রেখে শেষ পর্যন্ত তাদের বাদ দিয়ে কেবল ঢাকা-১৮ আসনে জিএম কাদেরের স্ত্রী শেরিফা কাদেরকে রেখে আসন সমঝোতা করা হয়। ঢাকায় শেরিফা কাদের ছাড়া কাউকেই আসন দেওয়া হয়নি। পার্টি চেয়ারম্যান জিএম কাদেরের নির্দেশে আসন সমঝোতায় নেতৃত্ব দেন দলের মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু ও সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ।
তারা নিজেদের আসন ঠিক রেখে নেতাকর্মীদের অন্ধকারে রেখে গোপনে এই সমঝোতা চূড়ান্ত করেন বলে অভিযোগ রয়েছে। বড় ধরনের হাঙ্গামার ভয়ে নাসরিন হাওলাদারকে বাদ দিয়ে দলের প্রভাবশালী কো-চেয়ারম্যান এবিএম রুহুল আমিন হাওলাদারকে আসন সমন্বয়ে অন্তর্ভুক্ত করেছেন। তাছাড়া মশিউর রহমান রাঙ্গার আসনে ভাতিজা আসিফ শাহরিয়ার, ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ আসনে রেজাউল ইসলাম ভূঁইয়ার পাশাপাশি দলের যুগ্ম মহাসচিব আব্দুল হামিদ ভাসানি, চট্টগ্রাম-৮ এ সোলায়মান আলম শেঠ, মানিকগঞ্জ একটি আসনে দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য জহিরুল আলম রুবেলকে সমঝোতা তালিকায় রাখা হয়েছে।
তাছাড়া ঠাকুরগাঁও-৩ আসনে হাফিজ উদ্দিন আহমেদ, নীলফামারী-৩ আসনে রানা মোহাম্মদ সোহেল, নীলফামারী-৪ আসনে আহসান আদেলুর রহমান, রংপুর-৩ আসনে জি এম কাদের, কুড়িগ্রাম-১ আসনে এ কে এম মুস্তাফিজুর রহমান, কুড়িগ্রাম-২ আসনে পনির উদ্দিন আহমেদ, গাইবান্ধা-১ আসনে শামীম হায়দার পাটোয়ারী, গাইবান্ধা-২ আসনে মো. আব্দুর রশিদ সরকার, বগুড়া-২ আসনে শরিফুল ইসলাম জিন্নাহ, বগুড়া-৩ আসনে মো. নুরুল ইসলাম তালুকদার, সাতক্ষীরা-২ আসনে মো. আশরাফুজ্জামান, বরিশাল-৩ আসনে গোলাম কিবরিয়া টিপু, পিরোজপুর-৩ আসনে মো. মাশরেকুল আজম, ময়মনসিংহ-৫ আসনে সালাহ উদ্দিন আহমেদ মুক্তি, ময়মনসিংহ-৮ আসনে ফখরুল ইমাম, কিশোরগঞ্জ-৩ আসনে মো. মুজিবুল হক চুন্নু, হবিগঞ্জ-১ আসনে মো. আব্দুল মুনিম চৌধুরী, মো. ফেনী-৩ আসনে মাসুদ উদ্দিন চৌধুরী, চট্টগ্রাম-৫ আসনে আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনে সেলিম ওসমানকে রাখা হয়। ইতোমধ্যে এসব আসনে নৌকার প্রার্থীরা মনোনয়ন প্রত্যাহার করে নিয়েছেন।
জানা গেছে, শুক্রবার আসন সমঝোতা চূড়ান্ত হলেও বড় ধরনের বিদ্রোহ-হাঙ্গামার ভয়ে দলের নেতারা বিষয়টি প্রকাশ করেননি। বরং, শুক্রবার রাতে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে ২৬ আসনের কথা বলা হলে প্রার্থী তালিকা থেকে বাদ পড়ার আশঙ্কায় নেতারা দলের চেয়ারম্যান, মহাসচিবের ওপর ক্ষোভ ঝাড়েন। তারা বিষয়টি জেনেও নেতাদের ক্ষোভ প্রশমনে এবং মনযোগ অন্যদিকে ফেরাতে নতুন নাটক মঞ্চস্থ করেন। বিক্ষুব্ধ নেতাকর্মীদের বলা হয়, আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে জাতীয় পার্টির প্রদত্ত তালিকা বাদ দিয়ে ২৬ এর কম আসন দেওয়া হচ্ছে। এটি কৌশলে প্রচার করা হলে নেতারা শনিবার রাত ১২টা পর্যন্ত ব্যারিস্টার আনিসের বাসায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন। এই নাটক চলে রোববার বিকেল পর্যন্ত। রোববার দিনভর নেতাকর্মীরা বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন। এতকিছুর পরও দলের মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু ২৬ আসনে সমঝোতার বিষয়টি কৌশলে এড়িয়ে যান।
সমঝোতার আসন থেকে বঞ্চিত দলটির এক প্রার্থী নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, নির্বাচন আসলে একটি চক্র সবসময় সুবিধা নেন। তৃণমূলের মতামত ছাড়া এবার বিশেষ কাউকে সুবিধা দেওয়া হবে না বলা হলেও নেতারা কথা রাখেননি। দলের চেয়ারম্যান নিজের কথার ওপর নিজেই অবিচল থাকতে পারেননি। তার ওপর নেতাকর্মীদের বিশ্বাস আর নেই।
তিনি বলেন, মনোনয়ন দেওয়া থেকে আসন সমঝোতা পর্যন্ত সবকিছুতে তৃণমূল নেতাকর্মীদের উপেক্ষা করে করা হয়েছে। যারা বারবার এমপি হয়েছেন, তারাই আবার এমপি হবেন। গোপন সমঝোতা করে দলের হাজারো নেতাকর্মীর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করা হয়েছে। এতে জাতীয় পার্টি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বরং নির্বাচনী নাটকের নামে হাজারো নেতার কাছ থেকে মনোনয়ন ফরম বিক্রি বাবদ বড় অংকের বাণিজ্য করা হয়েছে।
জানা গেছে, দলের মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু ২৮৩ আসনে নির্বাচনের ঘোষণা দিয়ে প্রার্থীদের সোমবার প্রতীক বরাদ্দ নেওয়ার নির্দেশ দিলেও তা মানছেন না অনেকেই। নির্বাচনী মাঠে থাকা অনেক নেতাই রোববার রাত থেকে মাঠ ছেড়ে দিয়েছেন। আর্থিক সঙ্কটে অনেক প্রার্থীই নির্বাচনের আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন। তাদের কেউ কেউ নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন, আবার নির্বাচনের আগেও সরে দাঁড়াতে পারেন। ইতোমধ্যে মনোনয়ন প্রত্যাহার হার করে নিয়েছেন জাতীয় পার্টির শীর্ষ পর্যায়ের অনেক নেতা। এর মধ্যে রয়েছেন ঢাকা-১৭ আসন থেকে জি এম কাদের, সালমা ইসলাম, ঢাকা-৬ আসনের কাজী ফিরোজ রশীদ, ঢাকা-৫ আসনের মীর আবদুর সবুর, ঢাকা-৭ আসনে তারেক আহমেদ আদেল, ঢাকা-১৩ ও ১৪ আসনে মোহাম্মদ শফিকুল ইসলাম সেন্টু।
নির্বাচন না করাকে ‘ব্যক্তি স্বাধীনতা’ উল্লেখ করে মনোনয়ন প্রত্যাহারের বিষয়ে দলের কো-চেয়ারম্যান কাজী ফিরোজ রশীদ বলেন, দলের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে নিজের ইচ্ছায় নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়িয়েছি। নির্বাচন করা না করায় প্রত্যেকের ব্যক্তি স্বাধীনতা রয়েছে।
নৌকার সঙ্গে সমঝোতার অংশ হিসেবে কেউ কেউ দলীয় প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে নিয়েছেন বলে জানা গেছে। তবে আসন সমঝোতায় নাম না থাকলেও ক্ষুব্ধ দলটির অনেক শীর্ষ পর্যায়ের নেতা নির্বাচনী মাঠে থাকছেন। তাদের মধ্যে ঢাকা-৪ আসনে দলের কো-চেয়ারম্যান সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা, প্রেসিডিয়াম সদস্য নারায়নগঞ্জ-৩ আসনে লিয়াকত হোসেন খোকা, প্রেসিডিয়াম সদস্য জামালপুরে মোস্তফা আল মাহমুদ, যুগ্ম মহাসচিব চট্টগ্রাম-সীতাকুণ্ড আসনে দিদারুল আলম দিদারসহ বেশ কিছু নেতা।
আসন সমঝোতার বিষয়ে কোনও মন্তব্য না করে সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা রাতে রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘এলাকায় কাজ করেছি। মানুষের সুখে-দুখে ছিলাম। নির্বাচন করছি। কাল বিকেল ৩টায় শ্যামপুর থানার দোলাইপাড় আমির টাওয়ারের সামনে থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে নির্বাচনী প্রচার শুরু করবো। সাত হাজারের বেশি কর্মী-সমর্থক নিয়ে প্রচার শুরু করবো’।
শেষ পর্যন্ত নির্বাচনী মাঠে থাকার কথা জানিয়েছেন নারায়নগঞ্জ-৩ সোনারগাঁও আসনের প্রার্থী লিয়াকত হোসেন খোকা। তিনি বলেন, নির্বাচন নিয়ে এলাকায় ব্যস্ত আছি। নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হলে সমঝোতা ছাড়াই ইনশা আল্লাহ জয়ী হবো।